শিরোনাম
সোনাদিয়া দ্বীপে রয়েছে সাত লাখ টন মূল্যবান খনিজ সম্পদ কক্সবাজারে পৌরসভা ও ব্র্যাকের উদ্যোগে বিশ্ব শহর দিবস উদযাপন ১৮৫ দেশ ভিসা ছাড়াই ঘুরে বেড়ানো যায় যে পাঁচ দেশের পাসপোর্টে 🇱🇰 শ্রীলংকা বনাম 🇧🇩 বাংলাদেশ ট্যুরিজম: কোথায় এগিয়ে, কোথায় পিছিয়ে? ইনানী নয়, পর্যটকবাহী জাহাজ সেন্টমার্টিন যাবে নুনিয়া ছড়া থেকে ট্যুরিজম ডেস্টিনেশন ডেভেলপমেন্ট খসড়া পরিকল্পনার উপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত রামুতে ‘জেন্ডার সচেতনতা ও সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক প্রশিক্ষণে বক্তারা: নির্যাতন-বৈষম্য রোধে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সামাজিক সচেতনতা ক্যারিয়ার কার্নিভাল ২০২৫: কর্মসংস্থানের পথে কক্সবাজারের তরুণদের নতুন যাত্রা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বাস সার্ভিস সুবিধা দিবে রামু স‌মি‌তি সানড্রি ক্রীড়া সংসদের ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠন

সোনাদিয়া দ্বীপে রয়েছে সাত লাখ টন মূল্যবান খনিজ সম্পদ

সিবিএল ডেস্ক: কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় বনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপটির আয়তন নয় বর্গকিলোমিটার। চারদিক দিয়ে জলরাশিতে আচ্ছাদিত এ ভূখণ্ডে মিলেছে ভারী প্রাকৃতিক খনিজ ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গারনেট, জিরকন, রুটাইল ও মোনাজাইট। সোনাদিয়ায় এ ধরনের মূল্যবান খনিজ সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক সাত লাখ টন। তবে গারনেট ও ইলমেনাইটের আধিক্যই সবচেয়ে বেশি। মূল্যবান এ সম্পদের আর্থিক হিসাব না মিললেও বাণিজ্যিকভাবে তা উত্তোলন করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা।

সোনাদিয়া দ্বীপের মূল্যবান সম্পদ নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা জার্নাল ‘ডিসকভার জিওসায়েন্স’। নিউজিলান্ডের ডুনেডিনের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার গবেষক মো. শাখাওয়াত হোসেন, মো. শাহরিয়ার রহমান, গোলাম তাকি ও মাফতুহা জাহান গবেষণাটি করেছেন।

‘জিওলজিক্যাল ক্যারিক্টারাইজেশন অ্যান্ড রিজার্ভ এক্সিমেশন অব দ্য ইকোনমিক হেভি মিনারেলস অব সোনাদিয়া আইল্যান্ড, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার মাধ্যমে দ্বীপের বিভিন্ন দিক তুলে আনা হয়। এর মধ্যে সোনাদিয়ার ভারী খনিজ সম্পদের পরিমাণ, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক মূল্য এবং দ্বীপের আধারে লুকিয়ে থাকা খনিজের প্রভাবকে দেয়া হয় বেশি গুরুত্ব। বালির নমুনা পরীক্ষা থেকে দেখা যায়, দ্বীপটিতে গারনেটের পরিমাণ ৫১ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ইলমেনাইট ৩৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া ম্যাগনেটাইট ৫ দশমিক ৭৪, জিরকন ১ দশমিক শূন্য ১, রুটাইল ৩ দশমিক ৫৭ ও মোনাজাইট দশমিক শূন্য ১ শতাংশ পাওয়া গেছে। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার চরেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মূল্যবান খনিজ ইলমেনাইট, রুটাইল, গারনেট, জিরকনসহ বিভিন্ন ম্যাগনেটাইটের উপস্থিতি উঠে এসেছে স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মাঠ সমীক্ষায়। সোনাদিয়া দ্বীপের বালিয়াড়িতে মূল্যবান ভারী খনিজ পদার্থের ঘনত্ব সৈকতের অন্য অংশ তীর (ফোরশোর) ও তীরবর্তী এলাকার (ব্যাকশোর) তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বলে দাবি করেন গবেষকরা। তারা জানান, দ্বীপে মজুদ থাকা ভারী খনিজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকা গারনেট বালিয়াড়ির বালিতে রয়েছে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬৮ টন। এছাড়া সমুদ্রের তীরের (ফোরশোর) বালিতে ১৯ হাজার ৭৯৪ টন ও তীরবর্তী এলাকার (ব্যাকশোর) বালিতে রয়েছে ৪৭ হাজার ৩২৪ টন গারনেট। বালিয়াড়ির বালিতে ইলমেনাইটের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার ৯২ টন। আর ফোরশোরে ১৫ হাজার ১৬ টন ও ব্যাকশোরে খনিজটির পরিমাণ ৩০ হাজার ৪৮৭ টনের মতো। সমুদ্রের ঢেউ, স্রোত এবং প্রকৃতিগতভাবে সোনাদিয়া অঞ্চলে নতুন নতুন পলি জমার কারণে মূল্যবান এ খনিজ সম্পদ ভবিষ্যতে সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।

গবেষণায় দ্বীপটিতে যে পরিমাণ ভারী খনিজ সম্পদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা যৎসামান্য বলে মনে করে ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জি (আইএমএমএম)। সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপে সাত লাখ টনের যে হেভি মিনারেল (ভারী খনিজ) পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এটা খুবই যৎসামান্য। এ সম্পদ বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে কিনা তা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কক্সবাজার, টেকনাফ, মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপের ভারী খনিজ সম্পদ নিয়ে ১৯৮০ সালেও গবেষণা হয়। তখনকার গবেষণায় ওই অঞ্চলে ২১ মিলিয়ন (২ কোটি ১০ লাখ) টন ভারী খনিজ সম্পদের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায়। বালি থেকে হেভি মিনারেলকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। তবে এটা অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা কতটা লাভজনক হবে সে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।’

ভৌগোলিক ও ব্লু ইকোনমির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে সোনাদিয়া দ্বীপ। এরই মধ্যে সেখানকার পর্যটন শিল্পসহ মৎস্য শিল্প দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। গত বছর এ দ্বীপে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার শর্তে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অনুকূলে ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমির বরাদ্দসংক্রান্ত একটি চুক্তি নিয়ে এগোয় অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এ পার্কসংক্রান্ত ওই চুক্তির বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে।

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, সরকার এখন নদীর বালিকে প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে। এজন্য লজিস্টিক সক্ষমতার প্রকল্পও নেয়া হয়েছে এরই মধ্যে। তবে সমুদ্র বা দ্বীপাঞ্চলের বালি নিয়ে সরকার এখনই ভাবছে না। প্রতি বছর নদীতে যে পরিমাণ পলি আসে তার ১০ ভাগও যদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারী খনিজের বাণিজ্যিক ব্যবহার করা যায় তাহলে বছরে ২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সোনাদিয়া দ্বীপের খনিজ সম্পদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তার জানা নেই বলে উল্লেখ করেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের ব্যাপারে আমাকে জানতে হবে। তবে সরকার নদীর বালি প্রক্রিয়াকরণের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে।’

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সোনাদিয়া দ্বীপ নিয়ে করা গবেষণায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি খনিজের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করেন গবেষকরা। এতে দেখা যায় জিরকন, রুটাইল ও ইলমেনাইটের মতো খনিজগুলোয় তাদের মূল উপাদানগুলো উচ্চ ঘনত্বে বিদ্যমান। এছাড়া অ্যাম্ফিবোল, মাস্কোভাইট, কোয়ার্টজসহ অন্যান্য খনিজের উপস্থিতি ও পরিমাণও নির্ণয় করা হয়েছে গবেষণায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে চিহ্নিত খনিজগুলোর মধ্যে ইলমেনাইট ও রুটাইল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো থেকে উৎপাদিত টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড রঙ, প্লাস্টিক, কাগজের আবরণ এবং বিশেষ ধাতু মিশ্রণের জন্য অপরিহার্য কাঁচামাল। জিরকন সিরামিক, কাচ ও ঢালাইয়ের কাজে উচ্চ তাপসহনীয়তা তৈরি করে এবং উৎপাদিত পণ্যে এনে দেয় চাকচিক্য। কেটে এ খনিজকে পলিশ করলে মূল্যবান রত্ন হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। গারনেট জেট-কাটিং ও পলিশে অসাধারণ অ্যাব্রেসিভ (মসৃণ কাজে ব্যবহৃত পদার্থ) হিসেবে এবং গহনা তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। মোনাজাইটে থাকে দুর্লভ উপাদান, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির টারবাইন থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকসেও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ম্যাগনেটাইট লোহা-ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল, আর কায়ানাইট রি-ফ্র্যাক্টরি ইট ও বিশেষ সিরামিকের জন্য দরকারি। অবকাঠামো নির্মাণ, পেইন্ট-প্লাস্টিক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তারের এসব খনিজের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। ফলে বালি বিক্রির বদলে খনিজ পৃথক, শোধন ও ব্র্যান্ডিংভিত্তিক রফতানির সুযোগ রয়েছে বহু গুণ।

দেশের দ্বীপাঞ্চল ও চরাঞ্চলের বালিতে থাকা ভারী খনিজ উত্তোলনে তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের নদীবাহিত এলাকার চরাঞ্চলে এবং সমুদ্রের দ্বীপ এলাকায় ভারী খনিজ পদার্থ রয়েছে। সরকার এরই মধ্যে এ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। বিশেষ করে যমুনার চরে হেভি মিনারেলগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠানকে সরকার লাইসেন্সও দিয়েছে।’

দ্বীপাঞ্চলে থাকা খনিজ নিয়ে সঠিক গবেষণা প্রয়োজন উল্লেখ করে ড. মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের মতো এলাকায় অবশ্যই হেভি মিনারেল আছে। আমার পরামর্শ হলো, এসব খনিজ সম্পদ নিয়ে সঠিক স্টাডি হওয়া প্রয়োজন। সরকার এরই মধ্যে চেষ্টা করছে। তবে শুরুতেই বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে যেন স্টাডি করা না হয়। কেননা, এসব খনিজ পদার্থের সঙ্গে অনেক রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট আছে, যেগুলো খুবই দামি। উন্নত দেশগুলো যেগুলো হন্যে হয়ে খুঁজছে। এ ধরনের এলিমেন্ট আমাদের দেশে থাকার সুযোগ আছে। তাই এ নিয়ে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ধীরেসুস্থে সঠিকভাবে স্টাডি করে আমাদের সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হোক।’

সুত্র: বণিক বার্তা




Developed by e2soft Technology